পৃথিবীকে নিঃকমিউনিস্ট করার গভীর অ্যাংলো-স্যাকসন চক্রান্ত

পৃথিবীকে নিঃকমিউনিস্ট করার গভীর অ্যাংলো-স্যাকসন চক্রান্ত
August 05, 2025

পৃথিবীকে নিঃকমিউনিস্ট করার গভীর অ্যাংলো-স্যাকসন চক্রান্ত

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ আপাতত শেষ। পৃথিবী থেকে কমিউনিস্টদের শেষ করে দেওয়ার ব্রিটেন-মার্কিন চক্রান্ত আপাতত থমকে গেল। যাঁরা প্রখ্যাত মার্কিন অর্থনীতিবিদ এবং সমাজতাত্ত্বিক জিওফ্রে স্যাক-এর ইওরোপ পার্লামেন্টে কয়েকদিন আগে দেওয়া বক্তৃতা শুনেছেন ও দেখেছেন তাঁরা এই বিষয়ে সম্যক অবগত আছেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রখ্যাত সমাজততত্ত্ববিদ ব্রেজেনস্কির রিপোর্ট থেকে স্যাক আমাদের জানাচ্ছেন, এই রুশ- ইউক্রেন যুদ্ধ ছিল ১৯৯১ সালে যখন সোভিয়েত রাশিয়াকে খণ্ড-বিখণ্ড করা হয় তখনকার একটি ‘প্রোজেক্টক্স। এই প্রোজেক্ট-এ শুধুমাত্র সোভিয়েত রাশিয়াকে খণ্ড-বিখণ্ড করা নয়, একে শেষ করে দেওয়ার পর চিনের দিকে হাত বাড়িয়ে চিনকে শেষ করে দেওয়ার প্রকল্পও নেওয়া হয়েছিল। এর জন্য NATO (North Atlantic Treaty Organization) নামক একটি সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে, ক্রমশ রাশিয়ার ভূখণ্ডের দিকে অগ্রসর হয়ে ইউক্রেনে, রাশিয়ার সীমান্তে পরমাণু অস্ত্রসম্ভার সজ্জিত করে সোভিয়েত রাশিয়াকে পদানত করার কথা ভাবা হয়েছিল। এই কারণে রুশ-আমেরিকা পরমাণু চুক্তিও বাতিল করা হয়। এই বিষয়গুলি যথাযথভাবে নথিভুক্ত হয়ে রয়েছে, বিস্তারিত বলার কিছু নেই এবং এখন নেটে সব পাওয়া যায়। এই সমস্তই হল পৃথিবীকে নিঃকমিউনিস্ট করার গভীর মার্কিনী চক্রান্ত, এর সঙ্গে ইওরোপও যুক্ত হয়েছিল। ইওরোপ বলতে আমি পশ্চিম ইওরোপের ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সের কথা বলছি। এই পর্যায়ে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হওয়ায় এই প্রকল্প আপাতত স্থগিত হয়ে গেল।
 

মার্কিন দেশে কে রাষ্ট্রপতি হয়ে এলেন, এর বিশেষ কোন অর্থ নেই কারণ তাদের পররাষ্ট্র নীতিতে চারটি বিষয় বিগত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে একই প্রকার রয়েছে এবং এটাই আমাদের মত হতদরিদ্র, ভিখারি মানুষজনের কাছে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এই নীতিতে রয়েছে—১. সোভিয়েত রাশিয়াকে দুর্বল করে পারলে ভেঙে ফেলা। ২. জার্মানী যেন কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। ৩. ইরানকে শেষ করে ফেলা। ৪. সমস্ত দিক থেকে চিনের প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
বলা যেতে পারে, অ্যংলো-স্যাকসন সাম্রাজ্যবাদীদের এই প্রকল্পের সূত্রপাত ঘটেছিল রুশ বিপ্লবের পর (১৯১৭), প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর; কিন্তু প্ৰবল পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন যে এমনই ভয়ানক হয়ে উঠবে তা বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং বিশ্ব ধনতান্ত্রিক শক্তি অনুমানও করতে পারে নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান ছিল একদিকে উত্থানরত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অন্যদিকে অটোমান সাম্রাজ্য পতনের মুখে। তাই লড়াই হয়েছিল একদিকে জাপান, ব্রিটেন, রাশিয়া, ইতালি এবং পরে কিছুটা আমেরিকার বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মান, অটোমান সাম্রাজ্যের। এই লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভয়ানক ধরনের বিশেষত স্প্যানিস ফ্লু মহামারীর আক্রমণের পর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রুশ সাম্রাজ্য বিধ্বস্ত হয়েছে এবং সেই সুযোগে রুশ কমিউনিস্টরা ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিনক্স গড়ে তোলার সুযোগ করে নিয়েছে; কিন্তু তখনও গৃহযুদ্ধে রুশ দেশের অবস্থা প্রায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। ক্রমশ সোভিয়েত দেশের উত্থান ঘটছে এবং বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী ও ধনতান্ত্রিক শক্তি অনুমান করতে পারছে এ এক অদ্ভুত শক্তির উত্থান ঘটছে যা ইতিপূর্বে কখনও কোথাও কোন রাষ্ট্রশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে নি। সেই দেশ সম্পর্কে নানা কথা সত্য-মিথ্যায় মিশিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে থাকল। পৃথিবীর বিশেষত মেহনতি, খেটেখাওয়া মানুষ সোভিয়েত রাশিয়ার নানা জনকল্যাণমুখী কর্মসূচির অভূতপূর্ব অগ্রগতির ব্যাপারে আকৃষ্ট হলেন। দেশে দেশে এমন সোভিয়েত দেশের ধাঁচের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠতে থাকল। বলতেই হবে বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিজম-সমাজবাদী ভাবধারার প্রভাব আগুনের মত ছড়িয়ে পড়তে থাকল।
 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অ্যাংলো-স্যাকসন জগত পিছু হটল, ব্রিটেন তার উপনিবেশ থেকে লুঠ করা সম্পদ আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিটে সরিয়ে ফেলল। ইওরোপ বিশেষত জার্মানি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত তবু তারা মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। কারণ আমেরিকা-ব্রিটেনের কাছে ভয়ানক শক্তি ছিল জার্মানি এবং সোভিয়েত রাশিয়া। গণমাধ্যমের এবং সামরিক আক্রমণের হুমকি দিয়ে হাজার চেষ্টা করেও তারা সোভিয়েত রাশিয়াকে ভাঙতে পারল না। যত দিন গেছে সোভিয়েত রাষ্ট্রের উন্নতি চোখে পড়ছে বিশেষ করে সেখানে স্তালিনের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাফল্য অভূতপূর্ব রূপে দেখা দিল। যেমন সমগ্র পৃথিবী তাকিয়ে দেখে চিনের দারিদ্র-দূরীকরণ কর্মসূচি। সমস্ত দিক থেকে বিধ্বস্ত এবং পিছিয়ে পড়া একটি দেশ কেমন করে এমন বৈষয়িক উন্নতি ঘটাতে পারে তা যুক্তি-বুদ্ধির বাইরে রইল। এই সঙ্গে ১৯৩০ সালে শুরু হল পৃথিবীব্যাপি মহামন্দা; কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সোভিয়েত রাশিয়ায় এর কোন প্রভাব পড়ল না। এইসব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে কমিউনিস্ট-বিরোধী প্রচার শুরু হল এবং সমগ্র পৃথিবীতে বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে যে এই ‘সমাজবাদী-সাম্রাজ্যবাদী' ভাবধারা ভবিষ্যতে ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে তা নিয়ে আমেরিকা-ইওরোপের সাম্রাজ্যবাদীরা অস্থির হয়ে উঠল। এরই ওপর ভিত্তি করে তারা গড়ে তুলল তাদের দীর্ঘস্থায়ী পররাষ্ট্রনীতি। একদিকে মজবুত অর্থনীতি গড়ে তুলে দুর্বল দেশগুলিকে ঋণে-ঋণে জর্জরিত করে তোলা, সামরিক অভিযান চালিয়ে ঐসব দেশের সদ্য গড়ে ওঠা সার্বভৌম শক্তিকে তছনছ করে দেওয়া এবং পরিকল্পিতভাবে সেসব দেশের বুদ্ধিজীবীদের কিনে নেওয়া এবং মগজধোলাইয়ের জন্য নানা উপঢৌকন দিয়ে অবিরত গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা।
 

ততদিনে জার্মানির আবার উত্থান ঘটছে তা চোখে পড়ার মত এবং চেষ্টা শুরু হল কেমন করে এই নাৎসি বাহিনীকে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেওয়া যায়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার গায়ে আঁচড় লাগে নি। ফলে তাদের ডলার চাঙ্গা থেকেছে, এই সুবাদে তারা সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর অর্থব্যবস্থাকে কা করার চেষ্টা করল এবং অনেক পরিমাণে সফল হল। তবু বিশ্বজুড়ে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার নিপীড়িত দেশগুলিতে স্বাধীনতা সংগ্রাম-মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছে এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সোভিয়েত রাশিয়া এসবে মদত দিয়ে চলেছে। সুতরাং এমন উপনিবেশগুলি রক্ষা করার জন্য ইওরোপের দেশগুলি যেমন ফ্রান্স, বেলজিয়াম, হল্যান্ড প্রভৃতিরা আমেরিকার দিকে ঝুঁকে পড়ল। কারণ ইওরোপ বুঝতে পরল আমেরিকার সাহায্য ছাড়া এমন উপনিবেশ তারা রক্ষা করতে পারবে। এই বিচারে সোভিয়েত রাশিয়া তাদের শত্রুপক্ষে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই সেদিনেও ফ্রান্স, আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল থেকে এগারোটি উপনিবেশ সরিয়ে নিতে বাধ্য হল। রাশিয়া আফ্রিকাকে মদত দিল। এ ব্যাপারে আমেরিকার সাহায্য চেয়েও ফ্রান্স শেষ রক্ষা করতে পারল না। অন্যদিকে বেলজিয়াম, কঙ্গোর কমিউনিস্ট নেতা প্যাট্রিস লুমুম্বাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে যে উন্নতমানের ইউরেনিয়াম লুঠ করেছিল, তা আমেরিকাকে উপহার দিল ম্যানহ্যাটনে পরমাণু বোমা তৈরি করার জন্য। এই পরমাণু বোমা নিঃক্ষেপ করা হল জাপানে, যদিও তা এই কমিউনিস্ট দেশগুলিতেই নিঃক্ষেপ করার কথা ভাবা হয়েছিল।আর একদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের উত্থান ঘটছে, একটা শক্তিশালী ধর্মনিরপেক্ষ জনআন্দোলন গড়ে উঠছে, তাই তাদের কব্জায় রাখার জন্য ইস্রায়েলের প্রতিষ্ঠা ও একে সমস্ত দিক থেকে মজবুত করে তোলা জরুরী হয়ে পড়েছিল। ব্রিটেন-আমেরিকা এতে সমস্ত দিক থেকে শক্তি জুগিয়ে গেল। ক্রমশ ইস্রায়েল হয়ে উঠল আমেরিকার একটি অলিখিত রাজ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব হতেই ইস্রায়েলের সমস্ত ভয়াবহ বিনাশকারী শক্তি দিয়ে এই অঞ্চলের বিপুল গণহত্যা ও সাম্রাজ্য গড়ে তোলার সব রকম প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্রসঙ্গত ২০০২-এ ইরাকে যে কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয় এর সম্পূর্ণ পরিকল্পনা ও কর্মপ্রক্রিয়া ছিল ইস্রায়েলের।
 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে আরও একটি সচকিত করার মত ঘটনা ঘটে গেল, কমিউনিস্ট চিনের উত্থান (১৯৪৯)। সুতরাং আমেরিকা প্রমাদ গুণল যে জোড়া বিপদ উপস্থিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) অ্যাংলো-স্যাকসন সাম্রাজ্যবাদীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল এই সুযোগে কমিউনিস্টদের ধ্বংস করে দেওয়া এবং এর জন্য তারা সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে জার্মানিকে লাগিয়ে দিল এবং আমেরিকা, জার্মানির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সোভিয়েত রাশিয়াকে বিপুল পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র দিল। পরিণামে এই যুদ্ধ লড়তে গিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রায় দেড় কোটি মানুষ মারা গেল; কিন্তু জার্মানি বিধ্বস্ত হয়ে গেল, পরবর্তীকালে তারা আমেরিকার পদানত হয়ে রইল। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও সোভিয়েত রাশিয়াকে পরাজিত করা গেল না এবং পৃথিবীব্যাপি তার প্রভাব বাড়তেই থাকল। অন্যদিকে চিনের উত্থান আমেরিকাকে আরও শঙ্কিত করে তুলল।
 

তৃতীয় বিশ্বের অন্য দেশগুলি নিয়ে আমেরিকার তেমন চিন্তা ছিল না। তারা উপনিবেশ থেকে সদ্য স্বাধীনতা পেয়ে সমস্ত দিক থেকে জর্জরিত হয়ে রয়েছে। তাই পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমের প্রচার, ঋণভাবে জর্জরিত করা, সে দেশের উঠতি বুদ্ধিজীবীদের কিনে ফেলা এবং সবশেষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামরিক অভিযান চালিয়ে (Proxy War) দেশটাকে দখল করে পুতুল সরকার বসানো, এই সবই চলতে থাকল। পাঠকদের অবগতির জন্য কয়েকটা মামুলী তথ্য দিয়ে রাখি। সিয়া (CIA, Central Intelligence Agency) হল গুপ্তচরবৃত্তি দ্বারা কোন দেশকে চুরমার করার আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এবং ‘যা করছি বেশ করছি” এই মনোভাব নিয়ে তারা সমগ্র পৃথিবীতে বিশেষত দুর্বল দেশগুলিতে সিয়াকে দিয়ে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে। আমেরিকার বাইরে এর সব থেকে বড় দুটি কেন্দ্রর একটি হল অস্ট্রেলিয়ায় এবং অন্যটি ইস্রায়েলে। এই সিয়াকে কাজে লাগিয়ে ১৯৬৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায় এক রাতে পাঁচ লাখ, ব্রাজিলে এক লাখ কমিউনিস্ট হত্যা করা হয়েছে। এমনিভাবে সমগ্র লাতিন আমেরিকার ও মধ্য আমেরিকার প্রায় প্রতিটি দেশে কয়েক ডজন বার পছন্দমতো সরকার বদলানো হয়েছে, লাখ লাখ গণহত্যা করা হয়েছে—এককথায় সমাজবাদী-কমিউনিস্টদের শেষ করে দেওয়া হয়েছে। এই সমস্ত তথ্য নেটে যে কেউ পেতে পারেন বিস্তারিতভাবে রয়েছে, তাই এখানে ভারাক্রান্ত করছি না।
 

ভারতবর্ষে নেহেরুর আমল থেকে রুশ-প্রেম আমেরিকার কাছে অত্যন্ত চিন্তার বিষয় ছিল। পঞ্চশীল পরিকল্পনায় চিন-ভারতের বন্ধুত্ব-এ আমেরিকা খুবই বিচলিত হয়ে পড়ে। তাই আমেরিকা ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেশী দেশগুলিকে কাজে লাগিয়েছে ভারতবর্ষকে যুদ্ধ এবং সন্ত্রাসবাদী ঘটনায় ব্যস্ত রাখার জন্য। যেমন আমেরিকার প্ররোচনায় চিন-ভারত যুদ্ধ হয়, পাকিস্তানকে আমেরিকা ধারাবাহিকভাবে সাহায্য করে এসেছে ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপে যুক্ত করার জন্য। আমেরিকার দাসত্ব করার জন্য পাকিস্তানের চরম ক্ষতি হয়েছে এবং তারা ভারতবর্ষেরও চরম ক্ষতি এখনও করে চলেছে। ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট-সমাজবাদী শক্তিকে শেষ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমেরিকা মদত দিয়েছে যার মধ্যে অন্যান্য কাজের মধ্যে ছিল বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশকে কিনে ফেলা। যেমন ৬০ ও ৭০-এর দশকে কলকাতায় গণআন্দোলন দুর্বার হয়ে উঠেছিল, তাই সিয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাহক হিসাবে বুদ্ধদেব বসু, গৌরকিশোর ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শংকর প্রমুখ বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে সিয়াকে সাহায্য করেছিল। এখনও আমেরিকার মদতে মোদি সরকার তৎপর ভারতবর্ষ থেকে কমিউনিস্ট ও সমাজবাদীদের ভাবধারাকে নিঃশেষিত করে ফেলার জন্য।


জন্মলগ্নের সময় থেকেই চিনকে শেষ করে দেবার জন্য আমেরিকা তৎপর ছিল। শুরু হল কোরিয়া যুদ্ধ, গড়িয়ে এল ভিয়েতনাম, লাওস, কাম্বোডিয়া, ততদিনে ইন্দোনেশিয়াকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে; কিন্তু চিনকে শেষ করা যায় নি। তবু প্রচেষ্ট থামে নি। আরও বিপদ হল, রুশ-চিন মৈত্রী যা ইদানীংকালে শোনা যাচ্ছে যে এই বন্ধুত্ব না কি Limitless Friendship'। এখন আমেরিকার প্রচেষ্টা হল কেমন করে এই বন্ধুত্ব ভেঙে ফেলা যায়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়াকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে আমেরিকা সন্তুষ্ট হয়েছিল যে আসল শত্রুর বিনাশ ঘটানো গেছে। কিন্তু ‘পুতিন’ যে গোকুলে বেড়েছে তা তারা বুঝতে পারে নি, শেষে বুঝল ২০০৭ সালের ‘মিউনিখ কনফারেন্স’-এ যখন যুবক পুতিন, আমেরিকাকে হুঁশিয়ারী দিল, এমন ‘Unipolar World' আমরা বরদাস্ত করব না। সমগ্র পাশ্চাত্য হতচকিত হয়ে গেল কারণ সব থেকে বেশি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে রুশদের কাছে। সুতরাং রুশ ভল্লুক ক্ষেপে গেলে সমূহ বিপদ। প্রচেষ্টা শুরু হল, কেমন করে একে দুর্বল করা যায়। নানা ছলেবলে কৌশলে ঝাঁপিয়ে পড়ল, কয়েকবার পুতিনকে হত্যার চেষ্টা করা হল; কিন্তু কিছুই কাজে এল না। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হল। উল্টে চিনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হল এবং এখন যে অবস্থায় চিন-রাশিয়ার সম্পর্ক দাঁড়িয়ে রয়েছে তা এককথায় অভূতপূর্ব। ছোট ছোট দেশগুলি যারা আমেরিকার ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকত তারা এখন উর্ধবাহু তুলে নৃত্য করছে। এখন আমেরিকা ক্রমে উপলব্ধি করতে পারছে তাদের পরাজয় নিশ্চিত, হাজার চেষ্টা করেও বিশ্বজয় অসম্ভব।


অগোছালোভাবে বিশ্বরাজনীতি-সমাজনীতি নিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে যে কথাগুলি লিখলাম তা কোন প্রবন্ধ লেখার তাগিদ থেকে নয়, ছেলেবেলা থেকে গড়ে ওঠা একটা স্বপ্নর বাস্তবায়নের তাগিদ থেকে। এই কথাগুলির একটিও আমার বানানো নয়, একটিও নতুন কথা বলি নি। সমস্ত নেটে পাওয়া যায়। আমি জানি, আমার এই আবেগ হয়তো ছেলেমানুষী; কিন্তু তা বিশুদ্ধ ও নিখাদ। ছেলেবেলায় ভিয়েতনামের মা লাই-এ নাপাম বোমা পড়ার পর উলঙ্গ বালক-বালিকার দল ছুটছে—এই দৃশ্য দেখার পর শিহরিত হয়ে শুধু ভেবেছি যদি আমাদের এখানে এমন হত! এই দৃশ্যকে অন্তরীকরণ করেছি এবং মাঝে মাঝেই এসব নিয়ে ভাবি, পাশ্চাত্যের সভ্য মানুষ কত নৃশংস হয়! এখনও অন্তর থেকে বিশ্বাস করি, দায়িত্ব পেলে এই পৃথিবীটাকে যুদ্ধহীন করে প্রতিটি শিশুর অন্তর্জাত ক্ষমতার বাস্তবায়নের জন্য একটা সর্বসমতাবাদী (Egalitarian) সমাজ গড়ে এর সুযোগ করে দিতে পারে লেনিন-মাও- সেতুং-এর কমরেডরা, কমিউনিস্টরা।
 

লেখক পরিচিতি পাভলভীয় মনোরোগ-চিকিৎসক, ‘মানবমন' পত্রিকার সম্পাদক।


Author:

বাসুদেব মুখোপাধ্যায়