Discounts up to 40% on new books
ঠিক কি আমাদের উত্তেজনা যোগায়, বা নিদেনপক্ষে উৎসাহ! এ মানবমনের মধ্যে নিরন্তর হতে থাকা এক প্রায় অভেদ্য প্রশ্ন। শুধু কিছুজন, আমাদের মত, যখন খুঁজে পায় এ প্রশ্নের উত্তর; ভেদ করতে পারে সেই প্রশ্নবাণকে - তারপরে তার আর জীবন থেকে হারাবার কিছু থাকে না। আমরা সব উৎসাহ, সব উত্তেজনা সঁপে দিয়ে বসে আছি পর্বতের পদপ্রান্তে, পর্বত-গাত্রে, কখনও বা পর্বতের চূড়ায়। সেই অভিজ্ঞতাই ভাগ করে নেব সকলের সাথে।
সালটা ২০২৩, এপ্রিলের শেষের দিকে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প অভিযান করে ফিরছিলাম। ফেরার পথে কিছু মানুষ কে দেখি পাহাড়ের গা বেয়ে অন্য পথে উপরের দিকে উঠে যেতে। আমাদের গাইড এর থেকে জানতে পারি মিরা নামের একটা পর্বত আছে যেটা মকালু-বরুণ ন্যাশনাল পার্ক এর মধ্যে অবস্থিত আর তার ঠিক পাশেই সাগরমাথা ন্যাশনাল পার্ক। উচ্চতা ৬৫০০ মিটারের মতো। এখানের মানুষ ভালোবেসে "Sister of Himalayas" বলে ডাকে। মিরা পর্বত আরোহণের স্বপ্ন সেইদিনের।
বাড়ি ফেরার পর খোঁজ নেওয়া শুরু করি পরের বছর আরোহণের জন্য। আমার টিম মেম্বারদের জানাই প্ল্যানটার কথা। সবাই রাজি হয়। কিন্তু এখানেই প্ল্যানিং শেষ নয়; জানতে পারি শুধু ট্রেক করেই শীর্ষে পৌঁছাতে পারব না। সাথে আরোহণ করতে হবে। এর আগে কখনো আরোহণে (Climbing) যাইনি। না আমি এর আগে কখনও কোনো পর্বত আরোহণের সাক্ষী ছিলাম। তারপর থেকেই শুরু করি দেশ বিদেশের জানা অজানা মানুষদের কাছ থেকে আরোহণের পর্যাপ্ত তথ্য নেওয়া। সব কিছু প্ল্যানিং করে ২০২৪ সালের ৫ ই এপ্রিল হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে বেরিয়ে পড়ি বিহারের রকশাল বর্ডার এর উদ্দেশ্যে। পরের দিন সকালে পৌঁছেই অতিক্রম করি ভারত-নেপাল সীমানা; বদলে নিতে হয় ভারতীয় অর্থ নেপালের টাকায়। দুটোই যদিও রুপি; একটা ভারতীয়, একটা নেপালী। তারপর শেয়ার গাড়ি ধরে কাঠমান্ডু এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়া গেল। কিছুটা যাবার পরই দেখা পাই ছোট বড় অনেক পাহাড়ের সাথে কিছু খরস্রোতা নদীর। রাস্তায় কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে চটপট মোমো খেয়ে আবার চলা শুরু। একটা একটা করে ছোট বড় পাহাড় পেরিয়ে গাড়ি এগোতে থাকে। পাহাড়ের বুকে কতো কতো ছোট বড় গ্রাম। কোথাও প্রাথমিক শিক্ষালয় আছে তো কোথাও প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র। এখানের মানুষরা নিজেরাই পাহাড়ের কোলে বাড়ির সামনেই আল কেটে চাষ করে নিজেদের খাবার। নাহলে দৈনন্দিন খাবার জোগাড়ের জন্য হাঁটতে হবে অনেকটা পথ। দিনের শেষে ছয় ঘণ্টা পরে পৌঁছাই কাঠমান্ডুতে।
এই শহরে আমার আসা এই প্রথম বার না। এর আগেও এসেছি হিমালয় দেখার জন্যেই। তাই পরিচিত হোটেলেই সেই রাতের বিশ্রাম। পৌঁছেই আমাদের এজেন্সি এর থেকে সংগ্রহ করি আমাদের আরোহণের অনুমতিপত্র। বলে রাখা ভালো নেপাল সরকার কে অভিযান খরচের প্রায় চল্লিশ শতাংশ দিতে হয় অনুমতি পত্রের জন্য। তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়া। ঠিক ভোর ৩:৩০ এর মধ্যে আবার গাড়ি চেপে চলে যেতে হবে বুঙ নামের একটা গ্রামে। পরের দিন সেখান থেকেই শুরু হবে অভিযান, এইসময় ভরপুর রোমাঞ্চ প্রতি অভিযাত্রীর মত আমাদেরও ঘিরে ছিল সর্বদা। আসলে বার বার হিমালয়ের কাছে ছুটে আসা এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য আর বুক ভরে কিছুদিন নিশ্বাস নেবো বলেই।
সারাদিনের পর বিকাল ছয়টা নাগাদ বুঙ গ্রামে পৌঁছাই। এখানের উচ্চতা ২২০০ মিটার মতো। এখানেই আছে বাচ্চাদের জন্য পাঠশালা আর দৈনন্দিন জীবনের দরকারি জিনিস পাওয়ার কয়েকটা দোকান। আছে প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। আছে আরোহীদের থাকার জন্য কিছু ট্রেক হাট। এর উপরে রাত কাটানোর জন্য ট্রেক হাট ছাড়া বাকি কিছুই পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে না স্থায়ী ইলেক্ট্রিকের কোনো ব্যবস্থা। রোদ উঠলে তবেই সোলার সিস্টেম থেকে সামান্য ইলেকট্রিক পাওয়া যাবে ট্রেক হাট গুলোতে। পৌঁছানোর পরেই শুরু হয় শিলা বৃষ্টি। সাথে আকাশের গর্জন। বাইরে চারপাশ টা দেখে মনে হচ্ছিল এ যেনো প্রলয়ংকর নটরাজের তাণ্ডব নৃত্য চলছে।
এখান থেকে আরো চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার পথ গাড়ি যায়। কিন্তু তাতে সময় লাগবে অন্তত তিন ঘণ্টা। কারণ রাস্তা খুব খারাপ। তাই নিজেরা ঠিক করি পায়ে হেঁটেই এগোতে হবে নাহলে সময়ের অভাবে আরো একদিন এখানে বিশ্রাম নিতে হবে। ট্রেকের প্রথম দিন প্রাতরাশ সেরে বেরোনোর আগেই ট্রেক হাটের দিদি আমাদের উত্তরীয় পরিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে আঁকাবাকা পথ উপরের দিকে উঠে গেছে। পথে আমরা আর ঘন জঙ্গলের নাম না জানা অনেক রকম পাখির ডাক, পোকাদের কলরব সাথে হাওয়ার নানান রকমের সুর। এগুলোকে সঙ্গী করেই নিজেদের শরীরকে একটু একটু করে উপরের দিকে তুলে নিয়ে যাওয়া। দীর্ঘ ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে দিনের শেষে পৌঁছাই চোলেম নামের একটা গ্রামে। গ্রাম বলাটা ভুল। দুটো বাড়ি আর সব মিলিয়ে মানুষের সংখ্যা দশ জন হবে। রাত টা এখানেই বিশ্রাম নিতে হবে। দ্বিতীয় দিনটা এখানেই বিশ্রাম নিতে হয় কারণ ভোর থেকেই শুরু হয় তুষারপাত। দুরু দুরু বুকে ভাবনায় পড়ি, এখানে চারিদিক বরফে ঢেকে গেলে উপরের দিকে অভিযানে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। কারণ চোলেমের উচ্চতা ৩৫০০ মিটার আর আমাদের পৌঁছাতে হবে ৬৪৭৬ মিটার উচ্চতায়। সারাদিন তাই বিশ্রাম আর মাঝে চারপাশ টা একটু হেঁটে ঘুরে দেখা ওই তুষারপাতের মধ্যেই। বলে রাখা ভালো আবহাওয়া খারাপ হবার জন্য ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হলো। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে কিছুই রইলো না। সব ঠিক না হওয়া পর্যন্ত বাড়ির সাথে যোগাযোগ করার আর কোনো উপায় নেই।
তৃতীয় দিন সব ভুলে সকালবেলা খাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়ি পরের গন্তব্যের দিকে। আগের দিনের তুষারপাতের জন্য রাস্তা ঢেকেছে বরফে। তাই চলার পথ দুর্গম হয়ে উঠেছে। সাবধানতার সাথে ক্রমশ এগিয়ে চলা। আমরা ৪৬০০ মিটার উচ্চতার একটা পাহাড় পেরিয়ে পৌঁছাই পঞ্চপোখরী নামের একটা জায়গায়। পোখরী কথার অর্থ হলো পুকুরের মতো একটা জায়গা। চারপাশের পাহাড়ের জল এখানে এসে জমা হয়। পাশাপাশি পাঁচটা পোখরী মিলে পঞ্চপোখরী। কিছুক্ষণ সেখানে জল বিরতির পর আবার এগিয়ে চলা। দিনের শেষে দীর্ঘ ২৮ কিমি পথ পেরিয়ে ৪৩০০ মিটারের উচ্চতায় অবস্থিত কোলাখারকা নামের একটা জায়গায় পৌঁছাই। আশেপাশে নেই কোনো গাছ। তাই রাতে আগুন পুইতে গেলে খরচ হবে মোটা টাকা। কারণ কাঠ আনতে অন্তত দশ কিলোমিটার নিচে নেমে আবার ঠিক ততটাই পথ উপরে উঠে আসতে হবে। পৌঁছে বুঝতে পারলাম উচ্চতা বেড়েছে সাথে কমেছে বায়ুর চাপ। এটা চারপাশটা দেখলেই বোঝা যায়। একটা বড় সুন্দর ফাঁকা ময়দানের মত জায়গা। মাঝে দাঁড়িয়ে আছে পাথর দিয়ে তৈরি একটাই ট্রেক হাট। দুই ভাই বোন মিলে ট্রেক হাট টা চালায়। দিদি খুব ভালো মনের। আমাদের দেওয়া ঝাল আচার খেয়ে দিদি খুব খুশি। রাতের হাড়কাঁপানো শীতে আমাদের জন্য কাঠ জেলে দিয়েছিলো। এক পয়সাও নিলো না। শুধু বলেছিলো "ইয়ে হামারি তারাফসে"। খাওয়াদাওয়া সেরে রাতটা এখানেই কাটালাম। চতুর্থ দিন যথারীতি আবার সকালে খাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়ি পরের গন্তব্যের দিকে। প্রথমে ঘণ্টা খানেকের চড়াই রাস্তা। তারপর উঁচু-নীচু রাস্তা পেরিয়ে রডোডেনড্রন বাগানের মাঝ দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে দিনের শেষে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে শোনকোষী নদীর বাম পার ধরে পৌঁছাই খোটে নামের একটা জায়গায়। এখানের উচ্চতা ৪৩৫০ মিটার। আগের তিন দিন পথে কোনো মানুষের দেখা পাইনি, শুধুই আমরা। পৌঁছে দেখি জায়গাটা অন্য গ্রামগুলোর তুলনায় বেশ কিছুটা জমজমাট। বেশ কিছু ট্রেক হাট আছে দেখে, কিছু তাঁবু পড়েছে আরোহীদের। পৌঁছে খাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়ি পায়ে হেঁটে চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে। রাতে বিশ্রাম নিয়ে সকালে বেরোনোর পালা। সেই রাতটা ছিল নেপালী নতুন বছরের প্রথম দিন। সেদিন দেখেছি পাহাড়ের বুকে একরাশ ভয় নিয়ে যারা দিনের পর দিন কাটাচ্ছে তাদের উদযাপন। পাহাড়ের মানুষ খুবই সহজ সরল; এরা আজ এই মুহূর্ত টা কে ভালোবাসে, আগামীর কথা ভাবে না। আমরাও তাদের উৎসবে সামিল হই, একসাথে নাচ গান সব মিলিয়ে বেশ ভালই আনন্দ করেছি সবাই। রাতটা কাটিয়ে পঞ্চম দিন বিকালে পৌঁছাই টাঙ্গনাক নামের একটা জায়গায়। এখন থেকেই গাছের দেখা শেষ। মিরা হিমবাহের ভেঙে নিচের দিকে নেমে এসে এই জায়গা টা তৈরি। চারিদিক টা শুধুই ছোট বড় নুরি পাথর ছড়িয়ে আছে। এখানের উচ্চতা ৪৭০০ মিটার। বেশ কিছু ট্রেক হাট আছে। পথে চোখে পরে পাহাড় গুলো থেকে হঠাৎ করেই একরাশ জমা বরফ ভেঙ্গে পড়ছে সাথে কান ফাটানো ভয়ংকর শব্দ। ষষ্ঠ দিন সকালে বেরিয়ে পৌঁছাই খারে নামের একটা জায়গায়। এখানের উচ্চতা ৪৯৯০ মিটার। এটাই মিরা পর্বত আরোহণ এর শেষ থাকার জায়গা। এর পরে আর কোনো ট্রেক হাট নেই। নেই জলের ঠিকানা। বরফ গলাতে পারলেই জল পানের সুযোগ নাহলে নয়। বাড়ির লোকজনের কাছে খবর পৌঁছাতে গেলে উপায় স্যাটেলাইট ফোন। খরচ বেস ভালই তাতে। প্রতি মিনিটের খরচ পাঁচশো নেপালি টাকায়। বাড়িতে জানালাম সবাই শারীরিক ভাবে সুস্থ্য আছি। জানালাম আবহাওয়া ভালো থাকলে আমরা আর তিন দিনের মধ্যে মিরা শৃঙ্গের শীর্ষে আরোহণ করতে পারবো। এখানে আমাদের দুই দিন বিশ্রামের পালা। বিশ্রামের সাথে রোজ সকালে উঠে উঁচু কোনো শীর্ষ ছুঁয়ে আবার নীচে নেমে আসা। দুপুরের খাবার খেয়েই আবার আরোহণের জন্য প্রশিক্ষণ; সাথে আরোহণের টুকিটাকি বুঝে নেওয়া আর নিজেদের তৈরি করে নেওয়া। শিখে নেওয়া কিভাবে পাহাড়ের গায়ে দড়ি বেঁধে পায়ের কাঁটা বরফে পুতে উপরে উঠতে হয় আর শরীর দড়িতে ঝুলিয়ে নিচের দিকে নামতে হয়। এভাবেই কাটলো একটা দিন। অষ্টম দিন এই উচ্চতায় নিজেদের শরীরকে বাতাসের কম অক্সিজেন আর কম বায়ুর চাপের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য মিরা বেস ক্যাম্প ছুঁয়ে আবার নেমে আসতে হয় খারে তে। ফেরার পর শেষ দিনের প্রশিক্ষণ সাথে দেখে নেওয়া -৩০° সেলসিয়াস বা তারও কম তাপমাত্রায় নিজেদের শরীরকে গরম রাখার পোশাক।
বলে রাখা ভালো মোটামুটি চার হাজার আটশো থেকে পাঁচ হাজার মিটার উচ্চতার পর থেকেই আমাদের শরীরে নতুন কোনো কোষ তৈরি হয়না কারণ এই উচ্চতায় আর গাছের দেখা পাওয়া যায়না বাতাসে কম অক্সিজেন এর কারণে। কোষের মৃত্যুর হার খুব তাড়াতাড়ি বাড়তে থাকে উচ্চতা বাড়ার সাথে। তাই একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শীর্ষ আরোহণ করে আবার নীচের দিকে নেমে আসতে হয়। নাহলে পাহাড়ের কোলেই ঘুমিয়ে যেতে হবে হয়তো সারাজীবনের মতো। আর এরকম জায়গা থেকে উদ্ধার সম্ভব নয়। অন্তত বেস ক্যাম্পে ফেরত এলে তবেই উদ্ধার সম্ভব আর তাতেও খরচ ভারতীয় অর্থে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা।
অবশেষে আমরা নবম দিন সকালে বেরোলাম মিরা পর্বত আরোহণের জন্য। প্রথমেই তিন ঘণ্টা উপরে ওঠার পর পৌঁছাই মিরা বেস ক্যাম্পে। সেখান থেকে আরো একশো মিটার যাবার পর ক্র্যাম্পন পয়েন্ট। এখান থেকেই জুতোর তলায় কাটা লাগিয়ে নিজেদের কে একে অন্যের সাথে দড়িতে বেঁধে হিমবাহের উপর দিয়ে আরোহণ শুরু। এক ঘণ্টা হাঁটার পর শুরু হয় প্রবল তুষারঝড়। এই ঝড়ের কথা ছোট বেলায় বইয়ের পাতায় পড়েছি। সেদিন নিজের চোখে দেখলাম, উপলব্ধি করলাম। সাবধানতার সাথে পেরোতে হলো ছোট বড় বরফের ফাটল। সামান্য অসাবধানতায় হতে পারে মৃত্যু। পোশাকের উপর জমা হচ্ছিল বরফের আস্তরণ। চশমা তে জমে যাচ্ছিল বরফ। এভাবেই এগিয়ে যাওয়া। প্রকৃতির অশেষ কৃপায় ঝড় একটু কম হতে, মনে একরাশ ভয় আর সাথে হার না মানা জেদ নিয়ে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা হাঁটার পর পৌঁছাই এডভ্যান্স ক্যাম্পে। রাস্তায় বিশ্রামের সুযোগ নেই। কোমরে বাধা দড়ির সামনে থেকে টান পড়লে বুঝতে হবে আগের জন এগিয়ে যাচ্ছে আমার থেকেও দ্রুত তাই পাল্টা টান দিয়ে তাকে বোঝানো যে আমি তার থেকে ধীরে এগোচ্ছি তাই সে যেন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। সেরকম পিছন থেকে দড়ির টান পড়লে বুঝতে হবে আমার থেকে ধীরে এগোতে পারছে আমার পিছনের জন তাই নিজে থেমে আমার সামনের দড়িতে টান দিয়ে আগের জনকেও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলা। এডভ্যান্স ক্যাম্পে পৌঁছাই দুপুর দুটো নাগাদ। সবাই সুস্থ ছিলাম কারণ এর আগেও আমরা অন্তত পাঁচবার, পাঁচ হাজার মিটারের বেশি উচ্চতার শৃঙ্গ আরোহণ করেছি তাই শরীর বোঝে এই ধকল, এই আবহাওয়া। পৌঁছে চা সাথে কিছু সুপ খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পরেই বেরোতে হবে শীর্ষ আরোহণের জন্য। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের এতদিনের স্বপ্ন পূরণ হবে এই উদ্দীপনায় চোখ বোজা দায়। সন্ধ্যে ছয় টার পরেই শুয়ে পড়া তাঁবুর নীচে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে। জীবনে প্রথম এতো উচ্চতায় রাত কাটাবো আমরা। চোখ বুজতেই রাত বারো টায় ডাক পড়ে তৈরি হবার জন্য। শেরপা এসে দিয়ে যান চা সাথে সুপ। রাত ১:৪৫ এর মধ্যে নিজেরা তৈরি হয়ে হেড টর্চের আলোয় বেরিয়ে পরি শীর্ষ আরোহণের জন্য। কিছুক্ষণ চলার পর শুরু হয় তুষার ঝড়। চারপাশটা শুধুই সাদা। দশ ফুট আগে আর দশ ফুট পিছনে ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এভাবেই একপা একপা করে শক্ত নীল বরফে কাটা আটকে একটু করে উপরের দিকে উঠে চলা। ভোর চার টে নাগাত প্রথম সূর্যের আলোয় চারপাশটা দেখি। তখনও সূর্য মাউন্ট মাকালুর ঠিক পিছনের দিকে। আজ অব্দি এই আকাশের রং কখনও তুলি দিয়ে সাদা খাতায় আঁচড় দিতে পারিনি। এই সৌন্দর্য্য দেখার জন্যই এত কষ্ট। এই স্বর্গসুখ পেতেই তো বার বার ছুটে আসা।
বেশিক্ষণ সময় কাটাতে পারব না কারণ বুকে কার্বন জমতে শুরু করেছে আর আরোহণের পর তাড়াতাড়ি নীচেও নামতে হবে নাহলে শরীরের শক্তি শেষ হয়ে যাবে নীচে নামার আগেই। কারণটা শুধুই উচ্চতা সাথে অক্সিজেনের অভাব আর একদম পাতলা বায়ুর চাপ। পথে কত আরোহীকে হাল ছেড়ে নিচে নেমে যেতে দেখেছি। কত কত মানুষকে দেখেছি পাহাড়ের বুকে বসে চোখের জল ফেলতে। দেখেছি কতো কতো মানুষের স্বপ্ন ভাঙতে। আমার মতো এদেরও স্বপ্ন মিরা পর্বতের শীর্ষ আরোহণের। হয়তো এরা আমার থেকেও বেশিদিন পাহাড়ে আসছে। হয়তো এরা আমার থেকেও বেশি অভিজ্ঞ। মনে ভয় বাড়তে থাকে। পথে দেখা হয় তেনজি নামের এক বিদেশী পর্বত আরোহীর সাথে। তার সাথে পরিচয় নিচের ক্যাম্পে। কথা বলে জানতে পেরেছিলাম সে পেশাদার পর্বতারোহী। তিনি নিজের জীবনের শেষ ৪০ টা বছর কাটিয়েছেন অভিযান করেই। বয়স ৬৪ বছর কিন্তু দেখলে বোঝা যায় না। নিজের ৫৪ বছর বয়সী স্ত্রী কে সাথে নিয়ে অভিযানে এসেছেন। মানুষটা খুবই সাধারণ আর খোলা মনের। একসাথে অনেক গল্প অনেক টা সময় একসাথে কাটিয়েছি আমরা। সে প্রতিনিয়ত আমাদের মানসিক ভাবে সাহস জোগাতে থাকে। তিনি বার বার বলতে থাকেন "You can, Push yourself, Be positive bro..." এভাবেই আর একটু আর একটু করে এগিয়ে যাওয়া। সেদিন তেনজি না থাকলে হয়তো পারতাম না। সবকিছু উপেক্ষা করে অবশেষে আর ঘণ্টা দুয়েক আরোহণের পর সকাল ৬:৩৫ (নেপাল সময়) পৌঁছাই মিরা সেন্ট্রাল পর্বত শীর্ষে। উড়িয়ে দিই ভারতের জাতীয় পতাকা। চারপাশটা দেখে চোখে জল চলে আসে। অবশেষে আমরাও পারলাম তাহলে। আমি সৌভিক বিশ্বাস (ক্যামেট), আনহিত ইউজেন (চিকু), সুজয় পাত্র আর কুমার চামলিং রাই (গাইড) সেদিন মিরা শৃঙ্গের উপর থেকে অর্ধেক পৃথিবী দেখেছি। এক বছর আগে দেখা একটা স্বপ্ন সেদিন স্বার্থক হলো। স্বপ্ন পূরণ হলো আমার সাথে আমার বাড়ির লোকেদের, আমার বন্ধুদের যারা অপেক্ষা আর প্রার্থনা করেছে আমাদের এই আরোহণের জন্য। সামনে থেকে দেখতে পাই পৃথিবীর ৫ টা ৮০০০ মিটারের বেশি উচ্চতার পর্বত শৃঙ্গ এভারেস্ট, লোথসে, মাকালু, কাঞ্চনজঙ্ঘা আর চয়ু। সাথে নাম জানা, না জানা বহু পাহাড় পর্বত। আগের বছর এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ট্রেকে এসে কালাপাথর এর উপর থেকে এভারেস্ট দেখেছিলাম আর আজ আমার পায়ের ছাপ ফেলে আসা সেই কালা পাথরের চুরা টা দুর থেকে দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাই নূপসে, আমাডাবলাম সাথে আগের বারের আরোহণ করা নাগার্জুন কারসাংলা পর্বতের চূড়া। মিনিট পনেরো এখানে থেকে আবার নীচে নামার পালা। ঘণ্টা তিনেক এর মধ্যে নেমে আসি এডভ্যান্স ক্যাম্পে। সেখানে সুপ আর নুডলস খেয়ে রওনা দিই বেস ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। আরো ৪ ঘণ্টা পরে পৌঁছাই বেস ক্যাম্পে। এডভ্যান্স ক্যাম্প থেকে বেস ক্যাম্প নামার সময় পৌঁছাই মিরা পাহাড়ের নিচের শীর্ষে আর মিরা-লা হিমবাহের শীর্ষে। আগের দিন তুষার ঝড়ের কারণেই এই দুটো জায়গার পাশ দিয়ে আমরা উপরের দিকে উঠে গেছি কিন্তু চোখেও পড়েনি। বেস ক্যাম্প পৌঁছে আবার ঘণ্টা দুয়েকের পথ পেরিয়ে খারে।
পৌঁছানোর পরেই ট্রেক হাটের মানুষজন উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করেন আমাদের সাথে দেন গরম জল আর কিছু খাবার। প্রতিনিয়ত আমাদের খেয়াল রাখেন কারণ আমরা শেষ সতেরো ঘণ্টা ধরে একটানা আরোহণ করেছি তাই শরীরে বিন্দুমাত্র জোর নেই। এই আপ্যায়ন কোনোদিনও ভোলার নয়। রাতে তেনজি শেরপা নিজের হাতে আমাদের জন্য মাংস রান্না করেন।
জমিয়ে আড্ডা দেওয়া হয়। জানতে পারি তার জীবন কাহিনী। তিনি দশ বারেরও বেশি মাউন্ট এভারেস্ট এর চূড়ায় নিজের পা রেখেছেন। আরোহণ করেছেন আট হাজারের বেশি উচ্চতার অনেক শৃঙ্গ। মিরা পর্বত অভিযানের পর তিনি যাবেন এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে। দরকার পড়লে আরোহণে যাওয়া কোনো মানুষ উপরে আটকে পড়লে তিনি উধারেও যাবেন। এটাই শেরপা দের জীবন। আমাদের মত মানুষের জীবনে এই শেরপা দের ভূমিকা বলে বোঝানোর না। বরফ গলিয়ে পান করার জল বানিয়ে দেওয়া থেকে সব কিছুই এদের জন্যই সম্ভব। এরাই পাহাড়ে আমাদের কাছে ভগবান তুল্য।
খারে তে রাতটুকু বিশ্রামের পর এক এক করে টাঙ্গনাক, খোটে, চোলাখারকা, সবুজে হয়ে পাঁচ দিন চলার পর পৌঁছাই রামাইলোডান্ডা বিকাল পাঁচটা নাগাত। সেখান থেকেই গাড়িতে করে সালারি নামের একটা শহরে পৌঁছাই রাত ১২ টায়। পরের দিন সালারি থেকে ভোর চার টের সময় শেয়ার গাড়িতে করে পৌঁছাই কাঠমান্ডু। অফিসিয়াল কাজ মিটিয়ে আরোহণের প্রশংসাপত্র নিয়ে ভারত নেপাল সীমানা পেরিয়ে বাড়ির পথে রওনা। সেদিন প্রথম নামের সাথে যুক্ত হয় পর্বত আরোহী কথাটা। আগামীতে আরো ছোট বড় সবরকম অভিযানের/আরোহণের সাক্ষী হতে চাই যতদিন হাড়ের জোর আছে।
হিমালয় তোমার কাছে বার বার ফিরে যেতে চাই।
সব শেষে সকলকে অনেক ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আমার বাবা-মা কে, যাদের হাত ধরে প্রথম পাহাড়ে যাওয়া। সবার আশীর্বাদ আর ভালোবাসায় আমাদের এই অভিযান ভালো ভাবে সম্পূর্ণ হয়েছে। সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। উন্নতির নামে পাহাড় ভাঙ্গা বন্ধ হোক। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ আর হাসিখুশি থাকুন,পাহাড় ভালবাসুন, পাহাড় পরিষ্কার রাখুন, পর্বত আরোহীদের পাশে দাড়ান। যতদিন পায়ের আর হাড়ের জোর আছে, পাহাড় ঘুরে নিন।